আপনি কি লক্ষ্য করেন না যে, আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীন যথাবিধি সৃষ্টি করেছেন [১]? তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করতে পারেন এবং এক নূতন সৃষ্টি অস্তিত্বে আনতে পারেন,
[১] এখানে আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে স্বশরীরে আবার পুনরায় নিয়ে আসতে তিনি যে সক্ষম সেটার পক্ষে দলীল পেশ করে বলছেন যে, মানুষ তো কোনো ব্যাপার নয়। যে আল্লাহ্ আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষে মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করা কোনো ব্যাপারই নয়। কারণ, মানুষের সৃষ্টির চেয়ে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করা বড় ব্যাপার। [ইবন কাসীর] আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের অন্যত্রও এটাকে তুলে ধরেছেন। যেমন “তারা কি দেখে না যে, আল্লাহ্, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোনো ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতের জীবন দান করতেও সক্ষম? বস্তুত তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। [সূরা আল-আহকাফ ৩৩]
“মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টি কথা ভুলে যায়। সে বলে, ‘কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন তা পচে গলে যাবে?’ বলুন, ‘তাতে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ তিনি তোমাদের জন্য সবুজ গাছ থেকে আগুন উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা থেকে প্রজ্বলিত কর। যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। তাঁর ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছে করেন, তিনি বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়। অতএব পবিত্র ও মহান তিনি, যাঁর হাতেই প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব; আর তাঁরই কাছে তোমরা ফিরে যাবে। [সূরা ইয়াসীন ৭৭-৮৩]
[১] অর্থাৎ তোমাদেরকে ধ্বংস করে সেখানে অন্যদের প্রতিষ্ঠিত করা তার জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। কোনো বড় ব্যাপার নয় আবার কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। বরং এটা তাঁর জন্য সহজ। যদি তোমরা তাঁর নির্দেশ অমান্য কর, তখন তিনি তোমাদেরকে ধ্বংস করে তোমাদের স্থলে অন্য কাউকে প্রতিস্থাপন করবেন। [ইবন কাসীর] অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন, “হে মানুষ! তোমরা তো আল্লাহ্র মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ্, তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসার যোগ্য। তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অপসৃত করতে পারেন এবং এক নূতন সৃষ্টি নিয়ে আসতে পারেন।” [সূরা ফাতির ১৫-১৭]
“যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন; তারা তোমাদের মত হবে না।” [সূরা মুহাম্মাদ ৩৮]
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসবে।” [সূরা আল-মায়িদাহ ৫৪]
“হে মানুষ! তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অপসারিত করতে ও অপরকে আনতে পারেন; আল্লাহ্ তা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।” [সূরা আন-নিসা ১৩৩]
আর তারা সবাই আল্লাহ্র কাছে প্রকাশিত হবে [১]। তখন দুর্বলেরা যারা অহংকার করত তাদেরকে বলবে, ‘আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম; এখন তোমরা আল্লাহ্র শাস্তি হতে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারবে [২]?’ তারা বলবে, ‘আল্লাহ্ আমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করলে আমরাও তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করতাম। এখন আমরা ধৈর্যচ্যুত হই অথবা ধৈর্যশীল হই- উভয় অবস্থাই আমাদের জন্য সমান; আমাদের কোনো পালানোর জায়গা নেই [৩]।’
[১] মূল শব্দ ‘বারাযা’। ‘বারাযা’ মানে সামনে উন্মুক্ত হওয়া। প্রকাশ হয়ে যাওয়া। [কুরতুবী] অর্থাৎ তারা কবর থেকে উন্মুক্ত হয়ে আল্লাহ্র সামনে হাযির হবে। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] প্রকৃতপক্ষে বান্দা তো সবসময় তার রবের সামনে উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু তারা যেহেতু গোনাহ করার সময় মনে করে যে, আল্লাহ্র কাছে সেটা গোপন থাকবে, তাই আল্লাহ্ তাদের সে সন্দেহ অপনোদন করে দিলেন। [ফাতহুল কাদীর] কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এখানে উন্মুক্ত হওয়ার অর্থ, কিয়ামতের দিন নেককার-বদকার সমস্ত সৃষ্টির এক প্রবল প্রতাপশালী আল্লাহ্র সামনে উপস্থিত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। তারা সেখানে এমন এক খোলা ভূমিতে একত্রিত হবে যেখানে কেউ নিজেকে গোপন করার কোনো সুযোগ পাবে না। [ইবন কাসীর] এ জন্য অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: “মানুষ উন্মুক্তভাবে উপস্থিত হবে আল্লাহ্র সামনে যিনি এক, প্রবল প্রতাপশালী।” [সূরা ইবরাহীম ৪৮]
[২] এটি এমন সব লোকের জন্য সতর্কবাণী যারা দুনিয়ায় চোখ বন্ধ করে অন্যের পেছনে চলে অথবা নিজেদের দুর্বলতাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে শক্তিশালী যালেমদের আনুগত্য করে, তাদের কথামত একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদাত করা থেকে দূরে ছিল, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেনি, তাদের জানানো হচ্ছে, আজ যারা তোমাদের নেতা হয়ে আছে আগামীকাল এদের কেউই তোমাদেরকে আল্লাহ্র আযাব থেকে সামান্যতম নিস্কৃতিও দিতে পারবে না। কাজেই আজই ভেবে নাও, তোমরা যাদের পেছনে ছুটে চলছো অথবা যাদের হুকুম মেনে চলছো তারা নিজেরাই কোথায় যাচ্ছে এবং তোমাদের কোথায় নিয়ে যাবে।
[৩] আয়াতদৃষ্টে মনে হয়, এ ঝগড়াটি জাহান্নামে প্রবেশের পরে হবে। যেমন, কুরআনের অন্যান্য স্থানেও এ ধরনের বর্ণনা এসেছে। বলা হয়েছে, “যখন যাদের অনুসরণ করা হয়েছে তারা, যারা অনুসরণ করেছে তাদের থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেবে এবং তারা শাস্তি দেখতে পাবে। আর তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, আর যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, ‘হায়! যদি একবার আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হতো তবে আমরাও তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম যেমন তারা আমাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে’। এভাবে আল্লাহ্ তাদের কার্যাবলী তাদেরকে দেখাবেন তাদের জন্য আক্ষেপস্বরূপ। আর তারা কখনো আগুন থেকে বহির্গমণকারী নয়।” [সূরা আল-বাকারাহ ১৬৬-১৬৭]
আরও এসেছে, “আর যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হবে তখন দুর্বলেরা যারা অহংকার করেছিল তাদেরকে বলবে, ‘আমরা তো তোমাদের অনুসরণ করেছিলাম সুতরাং তোমরা কি আমাদের থেকে জাহান্নামের আগুনের কিছু অংশ গ্রহণ করবে?’ অহংকারীরা বলবে, ‘নিশ্চয় আমরা সকলেই এতে রয়েছি, নিশ্চয় আল্লাহ্ বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন।” [সূরা গাফির ৪৭-৪৮]
আরও বলেন, “অবশেষে যখন সবাই তাতে একত্র হবে, তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, ‘হে আমাদের রব! এরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল; কাজেই এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দিন।’ আল্লাহ্ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না।’ আর তাদের পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদেরকে বলবে, ‘আমাদের উপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কাজেই তোমরা যা অর্জন করেছিলে, তার জন্য শাস্তি ভোগ কর।” [সূরা আল-আ’রাফ ৩৮-৩৯]
আরও এসেছে, “যেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, ‘হায়! আমরা যদি আল্লাহকে এবং রাসূলকে মানতাম!’ তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; ‘হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে দিন মহাঅভিসম্পাত।” [সূরা আল-আহযাব ৬৬-৬৮]
কিন্তু বিভিন্ন আয়াতদৃষ্টে মনে হয় যে, হাশরের ময়দানেও তারা ঝগড়া করবে, যেমন কুরআনের অন্যত্র এসেছে, “হায়! আপনি যদি দেখতেন যালিমদেরকে যখন তাদের রবের সামনে দাঁড় করানো হবে তখন তারা পরস্পর বাদ-প্রতিবাদ করতে থাকবে, যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, ‘তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হতাম।’ যারা ক্ষমতাদর্পী ছিল তারা, যাদেরকে দূর্বল মনে করা হত তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের কাছে সৎপথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে তা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম? বরং তোমরাই ছিলে অপরাধী।’ যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, ‘প্রকৃত পক্ষে তোমরাই তো দিনরাত চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, যখন তোমরা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহ্র সাথে কুফরী করি এবং তাঁর জন্য সমকক্ষ (শির্ক) স্থাপন করি।’ আর যখন তারা শাস্তি দেখতে পাবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং যারা কুফরী করেছে আমরা তাদের গলায় শৃংখল পরাব। তাদেরকে তারা যা করত তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” [সূরা সাবা ৩১-৩৩] এ ঝগড়াটি হবে হাশরের মাঠে। [ইবন কাসীর]
আর যখন বিচারের কাজ সম্পন্ন হবে তখন শয়তান বলবে, ‘আল্লাহ্ তো তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি [১], আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের উপর কোনো আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে ডাকছিলাম তাতে তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। কাজেই তোমরা আমাকে তিরস্কার করো না, তোমরা নিজেদেরই তিরস্কার কর। আমি তোমাদের উদ্ধারকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারকারী নও। তোমরা যে আগে আমাকে আল্লাহ্র শরীক করেছিলে [২] আমি তা অস্বীকার করছি। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
[১] অর্থাৎ আল্লাহ্ সত্যবাদী ছিলেন এবং আমি ছিলাম মিথ্যেবাদী। অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন, “সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনামাত্র।” [সূরা আন-নিসা ১২০]
আরও বলেন, “আর তোমার কণ্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো পদস্খলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও, আর তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও।’ আর শয়তান ছলনা ছাড়া তাদেরকে কোনো প্রতিশ্রুতিই দেয় না।” [সূরা আল-ইসরা ৬৪]
[২] এখানে আবার বিশ্বাসগত শির্কের মোকাবিলায় শির্কের একটি স্বতন্ত্র ধারা অর্থাৎ কর্মগত শির্কের অস্তিত্বের একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। যাকে ‘শির্ক ফিত তা’আহ’ বা আনুগত্যের ক্ষেত্রে শির্ক বলা হয়। একথা সুস্পষ্ট, বিশ্বাসগত দিক দিয়ে শয়তানকে কেউই আল্লাহ্র সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে শরীক করে না এবং কেউ তার পূজা, আরাধনা ও বন্দেগী করে না। সবাই তাকে অভিশাপ দেয়। তবে তার আনুগত্য ও দাসত্ব এবং চোখ বুজে বা খুলে তার পদ্ধতির অনুসরণ অবশ্যি করা হচ্ছে। এটিকেই এখানে শির্ক বলা হয়েছে। কুরআনে কর্মগত শির্কের একাধিক প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ইয়াহূদী ও নাসারাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, “তারা আল্লাহ্ ছাড়া নিজেদের “আহবার” (উলামা) ও “রাহিব” (সংসার বিরাগী সন্ন্যাসী)-দেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।” [সূরা আত-তাওবা ৩১] প্রবৃত্তির কামনা বাসনার পূজারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: “তারা নিজেদের প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে।” [সূরা আল ফুরকান ৪৩]
নাফরমান বান্দাদের সম্পর্কে এসেছে, “তারা শয়তানের ইবাদাত করতে থেকেছে।” [সূরা ইয়াসীন ৬০]
এ থেকে একথা পরিষ্কার জানা যায় যে, আল্লাহ্র অনুমোদন ছাড়াই অথবা আল্লাহ্র হুকুমের বিপরীত কোনো গাইরুল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য করতে থাকাও শির্ক। শরী’আতের দৃষ্টিতে আকীদাগত মুশরিকদের জন্য যে বিধান তাদের জন্য সেই একই বিধান, কোনো পার্থক্য নেই। [দেখুন, আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস, আশ-শির্ক ফিল উলুহিয়্যাহ ফিত তা’আহ অধ্যায়]
আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদেরকে প্রবেশ করানো হবে জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে স্থায়ী হবে, সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’ [১]।
[১] এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, জান্নাতীদের পরস্পর সাদর সম্ভাষন হবে সালাম। [আদওয়াউল বায়ান] আবার কারও কারও মতে, এ সালাম আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হবে। [বাগভী] অন্যত্র আছে যে, ফেরেশতাগণ জান্নাতীদেরকে এ শব্দে সাদর সম্ভাষণ জানাবে। যেমন, “যখন তারা জান্নাতের কাছে উপস্থিত হবে ও এর দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি ‘সালাম’, তোমরা সুখী হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য।” [সূরা আয-যুমার ৭৩]
“স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও এবং ফিরিশতাগণ তাদের কাছে উপস্থিত হবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে এবং বলবে, ‘তোমরা ধৈর্য্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এ পরিণাম!” [সূরা আর-রা’দ ২৩-২৪]
“তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ যেহেতু তারা ছিল ধৈর্য্যশীল, তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে।” [সূরা আল-ফুরকান ৭৫]
“সেখানে তাদের ধ্বনি হবে: ‘হে আল্লাহ! আপনি মহান, পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে, ‘সালাম’ এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবে: ‘সকল প্রশংসা জগতসমূহের রব আল্লাহ্র প্রাপ্য!” [সূরা ইউনুস ১০]
আপনি কি লক্ষ্য করেন না আল্লাহ্ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎবাক্যের [১] তুলনা উৎকৃষ্ট গাছ যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা উপরে বিস্তৃত [২],
[১] মূল আয়াতে (كَلِمَةً طَيِّبَةً) বলা হয়েছে। “কালেমা তাইয়েবা”র শাব্দিক অর্থ “পবিত্র কথা।” পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এ কালেমা। [বাগভী] এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
(كَلِمَةً طَيِّبَةً)
হলো: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য দেয়া আর
(كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ)
হলো মু’মিন। [ইবন কাসীর] এরপর
(اَصْلُهَا ثَابِتٌ)
এর অর্থ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মু’মিনের অন্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত।
(وَّفَرْعُهَا فِي السَّمَاۗءِ)
অর্থ, এ কালেমার কারণে এর মাধ্যমে মু’মিনের আমল আসমানে উত্থিত হয়। [ইবন কাসীর] আর এ তাফসীরই দাহহাক, সা’য়ীদ ইবন জুবাইর, ইকরিমাহ এবং কাতাদা সহ অনেক মুফাসসীর থেকে বর্ণিত হয়েছে। যার সারকথা হলো, উত্তম বৃক্ষ হলো মু’মিন যার তুলনা খেজুর গাছের সাথে বিভিন্ন হাদীসে দেয়া হয়েছে। খেজুর গাছ শুধু ভাল কিছুই উপহার দেয়। তেমনি ঈমানদার, শুধু ভালকাজই তার কাছ থেকে আসমানে উঠতে থাকে। সে ভাল কথা, ভাল কাজ করেই যেতে থাকে আর তা দুনিয়াতে হলেও তার ফলাফল নির্ধারিত হয় আকাশে। [ইবন কাসীর]
[২] এ আয়াতে মু’মিন ও তার ক্রিয়াকর্মের উদাহরণে এমন একটি বৃক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার কাণ্ড মজবুত ও সুউচ্চ এবং শিকড় মাটির গভীরে প্রেথিত। ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা থেকে সেগুলো সিক্ত হয়। গভীর শিকড়ের কারণে বৃক্ষটি এত শক্ত যে, দমকা বাতাসে ভূমিসাৎ হয়ে যায় না। ভূপৃষ্ঠ থেকে উর্ধ্বে থাকার কারণে এর ফল ময়লা ও আবর্জনা থেকে মুক্ত। এ বৃক্ষের দ্বিতীয় গুণ এই যে, এর শাখা উচ্চতায় আকাশ পানে ধাবমান। তৃতীয় গুণ এই যে, এর ফল সবসময় সর্বাবস্থায় খাওয়া যায়। এ বৃক্ষটি কি এবং কোথায়, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। সর্বাধিক তথ্যনির্ভর উক্তি এই যে, এটি হচ্ছে খেজুর বৃক্ষ। [আত-তাফসীরুস সহীহ] এর সমর্থন অভিজ্ঞতা এবং চাক্ষুষ দেখা দ্বারাও হয় এবং বিভিন্ন হাদীস থেকেও পাওয়া যায়। খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড যে উচ্চ ও মজবুত, তা প্রত্যক্ষ বিষয়-সবাই জানে। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘কুরআনে উল্লিখিত পবিত্র বৃক্ষ হচ্ছে খেজুর বৃক্ষ এবং অপবিত্র বৃক্ষ হচ্ছে হানযল তথা মাকাল বৃক্ষ।’ [তিরমিযি ৩১১৯, নাসায়ী ২৮২]
আব্দুল্লাহ্ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। জনৈক ব্যক্তি তার কাছে খেজুর বৃক্ষের শাঁস নিয়ে এল। তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামকে একটি প্রশ্ন করলেন: বৃক্ষসমূহের মধ্যে একটি বৃক্ষ হচ্ছে মর্দে-মু’মিনের দৃষ্টান্ত। (বুখারীর বর্ণনা মতে এ স্থলে তিনি আরো বললেন যে, কোনো ঋতুতেই এ বৃক্ষের পাতা ঝরে না।) বল, এ কোন বৃক্ষ? ইবন উমর বললেন: আমার মন চাইল যে, বলে দেই- খেজুর বৃক্ষ। কিন্তু মজলিশে আবু বকর, উমর ও অন্যান্য প্রধান প্রধান সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে চুপ দেখে আমি বলার সাহস পেলাম না। এরপর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এ হচ্ছে খেজুর বৃক্ষ।’ [বুখারী ৭২, ১৩১, ২২০৯, ৪৬৯৮, মুসলিম ২৮১১, মুসনাদে আহমাদ ২/১২, ২/৬১]
এ বৃক্ষ দ্বারা মু’মিনের দৃষ্টান্ত দেয়ার কারণ এই যে, কালেমায়ে তাইয়্যেবার মধ্যে ঈমান হচ্ছে মজবুত ও অনড় শিকড়বিশিষ্ট, দুনিয়ার বিপদাপদ একে টলাতে পারে না। সাহাবী ও তাবেয়ী; বরং প্রতি যুগের খাঁটি মুসলিমদের দৃষ্টান্ত বিরল নয়, যারা ঈমানের মোকাবেলায় জান, মাল ও কোনো কিছুর পরওয়া করেনি। দ্বিতীয় কারণ তাদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। তারা দুনিয়ার নোংরামী থেকে সবসময় দূরে সরে থাকেন যেমন ভূপৃষ্ঠের ময়লা-আবর্জনা উঁচু বৃক্ষকে স্পর্শ করতে পারে না। এ দু’টি গুণ হচ্ছে (اَصْلُهَا ثَابِتٌ)-এর দৃষ্টান্ত। তৃতীয় কারণ এই যে, খেজুর বৃক্ষের শাখা যেমন আকাশের দিকে উচ্চে ধাবমান, মু’মিনের ঈমানের ফলাফলও অর্থাৎ সৎকর্মও তেমনি আকাশের দিকে উত্থিত হয়। কুরআন বলে:
(اِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ)
[সূরা ফাতির ১০] -অর্থাৎ পবিত্র বাক্যাবলী আল্লাহ্ তা’আলার যেসব যিকর, তাসবীহ্-তাহলীল, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি করে, সেগুলো সকাল-বিকাল আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছতে থাকে। চতুর্থ কারণ এই যে, খেজুর বৃক্ষের ফল যেমন সব সময় সর্বাবস্থায় এবং সব ঋতুতে দিবারাত্র খাওয়া হয়, মু’মিনের সৎকর্মও তেমনি সবসময়, সর্বাবস্থায় এবং সব ঋতুতে অব্যাহত রয়েছে এবং খেজুর বৃক্ষের প্রত্যেকটি অংশই যেমন উপকারী, তেমনি মু’মিনের প্রত্যেক কথা ও কাজ, ওঠাবসা এবং এসবের প্রতিক্রিয়া সমগ্র বিশ্বের জন্য উপকারী ও ফলদায়ক। তবে শর্ত এই যে, আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুযায়ী হতে হবে। [দেখুন, ইবনুল কাইয়্যেম, ই’লামুল মুওয়াক্কে’য়ীন ১/১৩৩; আল-বাদর, তাআম্মুলাত ফী মুমাসালাতিল মু’মিন বিন নাখলাহ] উপরোক্ত বক্তব্য থেকে জানা গেল যে,
(تُؤْتِيْٓ اُكُلَهَا كُلَّ حِيْنٍ)
বাক্যে اُكُلٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে ফল ও খাদ্যোপযোগী বস্তু এবং حين শব্দের অর্থ প্রতিমুহূর্ত। এটিই সবচেয়ে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত। [তাবারী] যদিও এখানে অন্যান্য মতও রয়েছে। [দেখুন, তাবারী; বাগভী; কুরতুবী; ইবন কাসীর]
Contents of the translations can be downloaded and re-published, with the following terms and conditions:
1. No modification, addition, or deletion of the content.
2. Clearly referring to the publisher and the source (QuranEnc.com).
3. Mentioning the version number when re-publishing the translation.
4. Keeping the transcript information inside the document.
5. Notifying the source (QuranEnc.com) of any note on the translation.
6. Updating the translation according to the latest version issued from the source (QuranEnc.com).
7. Inappropriate advertisements must not be included when displaying translations of the meanings of the Noble Quran.
Resultado de pesquisa:
API specs
Endpoints:
Sura translation
GET / https://quranenc.com/api/v1/translation/sura/{translation_key}/{sura_number} description: get the specified translation (by its translation_key) for the speicified sura (by its number)
Parameters: translation_key: (the key of the currently selected translation) sura_number: [1-114] (Sura number in the mosshaf which should be between 1 and 114)
Returns:
json object containing array of objects, each object contains the "sura", "aya", "translation" and "footnotes".
GET / https://quranenc.com/api/v1/translation/aya/{translation_key}/{sura_number}/{aya_number} description: get the specified translation (by its translation_key) for the speicified aya (by its number sura_number and aya_number)
Parameters: translation_key: (the key of the currently selected translation) sura_number: [1-114] (Sura number in the mosshaf which should be between 1 and 114) aya_number: [1-...] (Aya number in the sura)
Returns:
json object containing the "sura", "aya", "translation" and "footnotes".