কুরআনুল কারীমের অর্থসমূহের অনুবাদ - বাংলা ভাষায় অনুবাদ- ড. আবূ বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া * - অনুবাদসমূহের সূচী


অর্থসমূহের অনুবাদ আয়াত: (23) সূরা: সূরা আন-নিসা
حُرِّمَتۡ عَلَيۡكُمۡ أُمَّهَٰتُكُمۡ وَبَنَاتُكُمۡ وَأَخَوَٰتُكُمۡ وَعَمَّٰتُكُمۡ وَخَٰلَٰتُكُمۡ وَبَنَاتُ ٱلۡأَخِ وَبَنَاتُ ٱلۡأُخۡتِ وَأُمَّهَٰتُكُمُ ٱلَّٰتِيٓ أَرۡضَعۡنَكُمۡ وَأَخَوَٰتُكُم مِّنَ ٱلرَّضَٰعَةِ وَأُمَّهَٰتُ نِسَآئِكُمۡ وَرَبَٰٓئِبُكُمُ ٱلَّٰتِي فِي حُجُورِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ ٱلَّٰتِي دَخَلۡتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمۡ تَكُونُواْ دَخَلۡتُم بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ وَحَلَٰٓئِلُ أَبۡنَآئِكُمُ ٱلَّذِينَ مِنۡ أَصۡلَٰبِكُمۡ وَأَن تَجۡمَعُواْ بَيۡنَ ٱلۡأُخۡتَيۡنِ إِلَّا مَا قَدۡ سَلَفَۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا
তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে [১] তোমাদের মা [২], মেয়ে [৩], বোন [৪], ফুফু [৫], খালা [৬], ভাইয়ের মেয়ে [৭], বোনের মেয়ে [৮], দুধমা [৯], দুধবোন [১০], শাশুড়ি ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সংগত হয়েছ তার আগের স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত মেয়ে, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে [১১], তবে যদি তাদের সাথে সংগত না হয়ে থাক তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই। আর তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী [১২] ও দুই বোনকে একত্র করা, আগে যা হয়েছে তা ছাড়া[১৩]। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
চতুর্থ রুকূ‘

[১] আলোচ্য আয়াতসমূহে যাদের সাথে বিয়ে হারাম, এমন নারীদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। তারা তিনভাগে বিভক্ত- এক. ঐ সমস্ত হারাম নারী কোনো অবস্থাতেই হালাল হয় না, তাদেরকে ‘মুহাররামাতে আবাদীয়া’ বা ‘চিরতরে হারাম মহিলা’ বলা হয়। এ জাতীয় মহিলা তিন শ্রেণীর: (১) বংশগত হারাম নারী, (২) দুধের কারণে হারাম নারী এবং (৩) শ্বশুর সম্পর্কের কারণে হারাম নারী চিরতরে হারাম। দুই. কোনো কোনো নারী চিরতরে হারাম নয়, কোনো কোনো অবস্থায় তারা হালালও হয়ে যায়। তাদেরকে ‘মুহাররামাতে মুআক্কাতাহ’ বা সাময়িক কারণে হারাম বলা হয়। এরা আবার দু’ শ্রেণীতে বিভক্ত: (১) পরস্ত্রী সে যতক্ষণ পর্যন্ত পরের স্ত্রী থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম। কিন্তু যখনই অপরের স্ত্রী হওয়া থেকে মুক্ত হবে তখনই সে হালাল হয়ে যাবে। (২) কোনো কোনো মহিলা শুধু অন্যের সাথে একসাথে বিবাহ করা হারাম। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবাহ করা হারাম নয়। যেমন, দুই বোনকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা। খালা ও বোনঝিকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা।

[২] অর্থাৎ আপন জননীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে। অর্থের ব্যাপকতায় দাদী, নানী সবই এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

[৩] স্বীয় ঔরসজাত কন্যাকে বিয়ে করা হারাম। কন্যার কন্যাকে এবং পুত্রের কন্যাকেও বিয়ে করা হারাম। মোটকথা, কন্যা, পৌত্রী, প্রপৌত্রী, দৌহিত্রী, প্রদৌহিত্রী এদের সবাইকে বিয়ে করা হারাম।

[৪] সহদোরা বোনকে বিয়ে করা হারাম। এমনিভাবে বৈমাত্রেয়া ও বৈপিত্রেয়া বোনকেও বিয়ে করা হারাম।

[৫] পিতার সহোদরা, বৈমাত্রেয়া ও বৈপিত্রেয়া বোনকে বিয়ে করা হারাম। তিন প্রকার ফুফুকেই বিয়ে করা যায় না।

[৬] আপন জননীর তিন প্রকার বোন, প্রত্যেকের সাথেই বিয়ে করা হারাম।

[৭] ভ্রাতুষ্পপুত্রীর সাথেও বিয়ে হারাম; আপন হোক বৈমাত্রেয় হোক - বিয়ে হালাল নয়।

[৮] বোনের কন্যা অর্থাৎ ভাগ্নেয়ীর সাথেও বিয়ে হারাম। এখানেও বোনকে ব্যাপক অর্থে বুঝতে হবে।

[৯] যেসব নারীর স্তন্য পান করা হয়, তারা জননী না হলেও বিবাহ হারাম হওয়ার ব্যাপারে জননীর পর্যায়ভুক্ত এবং তাদের সাথে বিবাহ হারাম। ফেকাহবিদগণের পরিভাষায় একে ‘হুরমাতে রেযাআত’ বলা হয়। তবে কেবলমাত্র শিশু অবস্থায় দুধ পান করলেই এই ‘হুরমাত’ কার্যকরী হয়।

[১০] অর্থাৎ দুধ পানের সাথে সম্পর্কিত যেসব বোন আছে তাদেরকে বিয়ে করা হারাম। এর বিশদ বিবরণ এই যে, দুধ পানের নির্দিষ্ট সময়কালে কোনো বালক অথবা বালিকা কোনো স্ত্রীলোকের দুধ পান করলে সে তাদের মা এবং তার স্বামী তাদের পিতা হয়ে যায়। এছাড়া সে স্ত্রীলোকের আপন পুত্র-কন্যা তাদেরই ভাই-বোন হয়ে যায়। অনুরূপ সে স্ত্রীলোকের বোন তাদের খালা হয় এবং সে স্ত্রীলোকের দেবর-ভাসুররা তাদের চাচা হয়ে যায়। তার স্বামীর বোনেরা শিশুদের ফুফু হয়ে যায়। দুধ পানের কারণে তাদের সবার পরস্পরের বৈবাহিক অবৈধতা স্থাপিত হয়ে যায়। বংশগত সম্পর্কের কারণে পরস্পর যেসব বিয়ে হারাম হয়, দুধ পানের সম্পর্কের কারণে সেসব সম্পৰ্কীদের সাথে বিয়ে করা হারাম হয়ে যায়। তাই একটি বালক ও একটি বালিকা কোনো মহিলার দুধ পান করলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না। এমনিভাবে দুধভাই ও বোনের কন্যার সাথেও বিয়ে হতে পারে না। উকবা ইবন হারেস বলেন, তিনি আবি ইহাব ইবন আযীযের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। এক মহিলা এসে বলল, আমি উকবাকে এবং যাকে সে বিয়ে করেছে উভয়কে দুধ পান করিয়েছি। উকবা বললেন, আমি জানি না যে, আপনি আমাকে দুধ পান করিয়েছেন। এর পূর্বে আপনি আমাকে কখনো বলেননি। তারপর তিনি মদীনায় আসলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কীভাবে এটা সম্ভব অথচ বলা হয়েছে। তখন উকবা তার স্ত্রীকে পৃথক করে দিলেন এবং অন্য একজনকে বিয়ে করেন। [বুখারী ৮৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে ছিলেন। এ অবস্থায় আয়েশা শুনতে পেলেন যে, হাফসার ঘরে যাওয়ার জন্য একজন পুরুষ লোক অনুমতি চাচ্ছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! একলোক আপনার পরিবারভুক্ত ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার তো মনে হয় এটা অমুক ব্যক্তি। হাফসার কোনো এক দুধ চাচা। তখন আয়েশা বললেন, অমুক যদি জীবিত থাকত-আয়েশার কোনো এক দুধ চাচা তাহলে কি সে আমার কাছে প্রবেশ করতে পারত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যা, জন্মগত কারণে যা হারাম হয়, দুধগত কারণেও তা হারাম হয়৷ [বুখারী ৫০৯৯; মুসলিম ১৪৪৪]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, জন্মের কারণে যাদেরকে হারাম গণ্য করো দুধ পানের কারণেও তাদেরকে হারাম গণ্য করবে। [মুসলিম ১৪৪৫]

তবে এ দুধপান দু’বছরের মধ্যে হয়েছে কি না সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন জরুরী; কারণ, হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুধ পানের সময়টুকু যেন ঐ সময়েই সংঘটিত হয় যখন সন্তানের দুধ ছাড়া আর কোনো খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হতো না। [বুখারী ৫১০২; মুসলিম ১৪৫৫]

[১১] এখানে অভিভাবকত্ব থাকার কথাটা শর্ত হিসাবে নয়; বরং সাধারণতঃ এ ধরনের মেয়েরা মায়ের সাথেই থাকে আর মা দ্বিতীয় বিবাহের কারণে তার স্বামীর কাছেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এ ধরনের মেয়েদের অভিভাবকত্ব থাকা না থাকা উভয় অবস্থাতেই তাদের বিয়ে করা হারাম। উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আবু সুফিয়ানের মেয়েকে বিয়ে করবেন? রাসূল বললেন যে, তাকে বিয়ে করা আমার জন্য জায়েয হবে না। আমি বললাম, আমি শুনেছি আপনি নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। রাসূল বললেন, তুমি কি উম্মে সালামার মেয়ের কথা বলছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, যদি সে আমার রাবীবা নাও হত তারপরও আমার জন্য জায়েয হত না। কেননা আমাকে এবং তার পিতাকে সুআইবাহ দুধ পান করিয়েছেন। তোমরা তোমাদের কন্যাদের এবং তোমাদের বোনদের আমার কাছে বিয়ের জন্য পেশ করো না। [বুখারী ৫১০৬]

[১২] অর্থাৎ আপন পুত্রের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম। যদিও পুত্র শুধু বিবাহই করে-সহবাস না করে।

[১৩] এখানে বুঝানো হয়েছে যে, পূর্বে এ ধরনের যা কিছু ঘটেছে তা আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু যদি কেউ এরূপ অবস্থায় ইসলামে প্রবেশ করে তবে তাদের মধ্য থেকে দু’জনের একজনকে তালাক দিতে হবে। হাদীসে এসেছে, ফাইরোয আদ-দাইলামী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললাম: আমি ঈমান এনেছি অথচ দুই বোন আমার স্ত্রী হিসেবে আছে। রাসূল বললেন, তুমি তাদের যে কোনো একজনকে তালাক দিয়ে দাও। [ইবন মাজাহ ১৯৫১, তিরমিযী ১১২৯]

অনুরূপভাবে এ একত্রিতকরণের মাস’আলার মধ্যে এমন দু’জনকেও একত্রে বিয়ে করা জায়েয নাই, যাদের একজন পুরুষ সাব্যস্ত হলে অন্যজনের জন্য তাকে বিয়ে করা জায়েয হত না। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মহিলা এবং তার ফুফু অনুরূপভাবে কোনো মহিলা ও তার খালাকে একত্রে বিয়ে করা যাবে না। [বুখারী ৫১০৯]
আরবি তাফসীরসমূহ:
 
অর্থসমূহের অনুবাদ আয়াত: (23) সূরা: সূরা আন-নিসা
সূরাসমূহের সূচী পৃষ্ঠার নাম্বার
 
কুরআনুল কারীমের অর্থসমূহের অনুবাদ - বাংলা ভাষায় অনুবাদ- ড. আবূ বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া - অনুবাদসমূহের সূচী

বাংলা ভাষায় আল-কুরআনুল কারীমের অর্থসমূহের অনুবাদ। ড. আবূ বকর যাকারিয়া কর্তৃক অনূদিত।

বন্ধ