এ কারণেই বনী ইসরাঈলের উপর এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা যমীনে ধ্বংসাত্মক কাজ করার কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে [১] সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল [২], আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল [৩]। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন, তারপর এদের অনেকে এরপরও যমীনে অবশ্যই সীমালংঘনকারী।
[১] আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কবীরা গোনাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শির্ক করা এবং কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। মিথ্যা কথা বলা অথবা বলেছেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ [বুখারী ৬৮৭১]
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাস বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো হক মা’বূদ নাই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তার রক্ত তিনটি কারণ ব্যতীত প্রবাহিত করা অবৈধ। জীবনের বদলে জীবন (হত্যার বদলে কিসাস)। একজন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অবৈধ যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং ঐ ব্যক্তি যে ইসলাম ত্যাগ করে এবং মুসলিম জামা'আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’ [বুখারী ৬৮৭৮]
[২] আল্লামা শানকীতী বলেন, এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে, অর্থাৎ হত্যার বিনিময়ে হত্যা কিংবা যমীনে ফেতনা- ফাসাদসূষ্টিকারী হবে না, যারা তাদের হত্যা করবে, তারা যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। এ আয়াতে যারা হত্যার বিনিময়ে হত্যা অথবা ফেতনা-ফাসাদসূষ্টিকারী হবে, তাদের কী অবস্থা হবে সেটা বর্ণনা করা হয় নি। তবে অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাও বর্ণনা করেছেন। যেমন, তিনি বলে দিয়েছেন, “আর আমরা তাদের উপর তাতে অত্যাবশ্যক করে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ যখম।” [সূরা আল-মায়েদাহ ৪৫] আরও বলেন, “হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস, নারীর বদলে নারী।” [সূরা আল-বাকারাহ ১৭৮]
আরও বলেন, “কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি তার প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি; কিন্তু হত্যা ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে।” [সূরা আল-ইসরা ৩৩] [আদওয়াউল বায়ান]
[৩] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কাউকে জীবিত করার অর্থ, আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম ঘোষণা করেছেন সে ধরনের কোনো মানুষকে হত্যা না করা। এতে করে সে যেন সবাইকে জীবিত রাখল। অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হারাম মনে করে, তার থেকে সমস্ত মানুষ জীবিত থাকতে সমর্থ হলো। [তাবারী]
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি কেবল এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে [১]। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও আখেরাতে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে [২]।
[১] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে কেউ ইসলামের শৃঙ্গে হাতিয়ার ব্যবহার করবে, যাতায়াতকে ভীতিপ্রদ করে দিবে, (ডাকাতি রাহাজানি করবে) তারপর যদি তাদেরকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়, তবে মুসলিম শাসকের এ ব্যাপারে ইখতিয়ার থাকবে, তিনি ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করবেন, নতুবা শুলে চড়াবেন অথবা তার হাত-পা কেটে দিবেন। [তাবারী] হাদীসে এসেছে, একদল লোক মদীনায় আসল, তারা মদীনার আবহাওয়া সহ্য করতে পারল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সাদকার উট যেখানে থাকে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দিলেন, যাতে তারা উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করতে পারে। কিন্তু তারা রাখালকে হত্যা করল এবং উটগুলোকে নিয়ে চলে যেতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পিছু ধাওয়া করতে নির্দেশ দিলেন। পরে তারা ধৃত হলো। তখন তাদের হাত-পা কেটে দেয়া হলো, চোখ উপড়ে ফেলা হলো এবং তাদেরকে মদীনার কালো পাথর বিশিষ্ট এলাকায় ফেলে রাখা হলো। [বুখারী ১৫০১, মুসলিম ১৬৭১]
[২] ইসলামী শরী’আতে অপরাধের শাস্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: হুদৃদ, কিসাস ও তাষীরাত। তন্মধ্যে যেসব অপরাধের শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করে দিয়েছে: তা হচ্ছে, হুদুদ ও কিসাস। পক্ষান্তরে যেসব অপরাধের কোনো শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করেনি; বরং বিচারকদের অভিমতের উপর ন্যস্ত করেছে, সেসব শাস্তিকে শরীআতের পরিভাষায় ‘তা’যিরাত’ তথা দণ্ড বলা হয়। কুরআনুল কারীম হুদুদ ও কিসাস পূর্ণ বিবরণ ব্যাখ্যা সহকারে নিজেই বর্ণনা করে দিয়েছে। আর দণ্ডনীয় অপরাধের বিবরণকে রাসূলের বর্ণনা ও সমকালীন বিচারকদের অভিমতের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ বিশেষ অপরাধ ছাড়া অবশিষ্ট অপরাধসমূহের শাস্তির কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি; বরং বিচারকের অভিমতের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বিচারক স্থান, কাল ও পরিবেশ বিবেচনা করে অপরাধ দমনের জন্য যেরূপ ও যতটুকু শাস্তির প্রয়োজন মনে করবেন, ততটুকুই দেবেন।
আলেমরা বলেন, কুরআনুল কারীম যেসব অপরাধের শাস্তিকে আল্লাহর হক হিসাবে নির্ধারণ করে জারি করেছে, সেসব শাস্তিকে ‘হুদূদ’ বলা হয় এবং যেসব শাস্তিকে বান্দার হক হিসেবে জারি করেছে, সেগুলোকে ‘কিসাস’ বলা হয়। কিসাসের শাস্তি হুদূদের মতই সুনির্ধারিত। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ সংহার করা হবে এবং জখমের বিনিময়ে সমান জখম করা হবে। কিন্তু পার্থক্য এই যে, হুদূদকে আল্লাহর হক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও তা ক্ষমা হবে না। কিন্তু কিসাস এর বিপরীত। কিসাসে বান্দার হক প্রবল হওয়ার কারণে হত্যা প্রবল হওয়ার পর হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে কেসাস হিসাবে তাকে মৃত্যুদণ্ডও করাতে পারে। যখমের কেসাসও তদ্রুপ। পক্ষান্তরে যেসব অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করেনি, সে জাতীয় শাস্তিকে বলা হয় ‘তা’যীর’ তথা ‘দণ্ড’। শাস্তির এ প্রকার তিনটির বিধান অনেক বিষয়েই বিভিন্ন। তন্মধ্যে তাযীর বা দণ্ডগত শাস্তিকে অবস্থানুযায়ী লঘু থেকে লঘুতর, কঠোর থেকে কঠোরতর এবং ক্ষমাও করা যায়। এ ব্যাপারে বিচারকদের ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক। কিন্তু হুদূদের বেলায় কোনো বিচারকই সামান্যতম পরিবর্তন, লঘু অথবা কঠোর করার অধিকারী নয়। স্থান ও কাল ভেদেও এতে কোনো পার্থক্য হয় না। শরী’আতে হুদুদ মাত্র পাঁচটি: ডাকাতি, চুরি, ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ -এ চারটির শাস্তি কুরআনে বর্ণিত রয়েছে। পঞ্চমটি মদ্যপানের হদ। এটি বিভিন্ন হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত। এভাবে মোট পাঁচটি অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত ও হুদৃদরূপে চিহ্নিত হয়েছে। [কুরতুবী থেকে সংক্ষেপিত]
তবে তারা ছাড়া, যারা তোমাদের আয়ত্তে আসার আগেই তওবা করবে [১]। সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[১] হুদুদ জাতীয় শাস্তি যেমন কোনো শাসক ও বিচারক ক্ষমা করতে পারে না, তেমনি তাওবা করলেও ক্ষমা হয়ে যায় না। তবে খাটি তাওবা দ্বারা আখেরাতের গোনাহ মাফ হতে অব্যাহতি লাভ হতে পারে। তন্মধ্যে শুধু ডাকাতির শাস্তির বেলায় একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। ডাকাত যদি গ্রেফতারীর পূর্বে তাওবা করে এবং তার আচার-আচরণের দ্বারাও তাওবার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে সে হদ থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু গ্রেফতারীর পর তাওবা ধর্তব্য নয়। অন্যান্য হুদুদ তাওবা দ্বারাও মাফ হয় না, হোক সে তাওবা গ্রেফতারীর পূর্বে অথবা পরে। [ইবন কাসীর অনুরূপ বর্ণনা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন]
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর[১]। আর তাঁর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।
ষষ্ট রুকূ‘
[১] অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ কর। (الْوَسِيْلَةَ) শব্দটি (وسل) ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ সংযোগ স্থাপন করা। পূর্ববর্তী মনীষী, সাহাবী ও তাবে’য়ীগণ ইবাদাত, নৈকট্য, ঈমান সৎকর্ম দ্বারা আয়াতে উল্লেখিত (وسيلة) শব্দের তাফসীর করেছেন। হাকেমের বর্ণনা মতে হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ওসীলা শব্দ দ্বারা নৈকট্য ও আনুগত্য বোঝানো হয়েছে’। ইবন জরীর আ’তা, মুজাহিদ ও হাসান বসরী রাহিমাহুমুল্লাহ থেকে এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। এ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর তাঁর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির কাজ করে। [তাবারী, ইবন কাসীর] অতএব, আয়াতের সারব্যাখ্যা এই দাড়ায় যে, ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অন্বেষণ কর। অন্য বর্ণনায় হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে এ আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনে বললেন যে, ওসীলা অর্থ, নৈকট্য। তারপর তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে যারা সংরক্ষণকারী তারা সবাই এটা ভালোভাবেই জানেন যে, ইবন উম্ম আব্দ (ইবন মাসউদ) তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত। [মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৩১২, অনুরূপ তিরমিযী ৩৮০৭, মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৯৫]
এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “জান্নাতের একটি উচ্চ স্তরের নাম ‘ওসীলা’। এর উর্ধ্বে কোনো স্তর নেই। তোমরা আল্লাহর কাছে দো’আ কর যেন তিনি এ স্তরটি আমাকে দান করেন।” [মুসনাদে আহমাদ ১১৩৭৪, আবু সাঈদ আল-খুদরী হতে]
অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন মুয়ায্যিন আযান দেয়, তখন মুয়াযযিন যা বলে, তোমরাও তাই বল। এরপর দুরূদ পাঠ কর এবং আমার জন্য ওসীলার দোআ কর।” [মুসলিম ৩৮৪] উপর্যুক্ত ওসীলা শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণের তাফসীর থেকে জানা গেল যে, যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ হয়, তাই অসীলা। পক্ষান্তরে শরীআতের পরিভাষায় তাওয়াস্সুলের অর্থ হল - আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা পালন করে এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা ও জান্নাতে পৌঁছা।
‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআন কারীমে দুটি স্থানে এসেছে: সূরা আল-মায়েদার ৩৫ নং আয়াত এবং সূরা আল-ইসরার ৫৭ নং আয়াত। আয়াতদ্বয়ে ওসীলার অর্থ হল আল্লাহকে সন্তুষ্টকারী কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। হাফেয ইবন কাসীর রাহেমাহুল্লাহ প্রথম আয়াতের তাফসীরে বলেন, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, ওসীলার অর্থ নৈকট্য। অনুরূপ তিনি মুজাহিদ, আবু ওয়ায়িল, হাসান বসরী, আবদুল্লাহ ইবন কাসীর, সুদ্দী, ইবন যায়েদ ও আরো একাধিক ব্যক্তি হতেও তা বর্ণনা করেন। আর সম্মানিত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দ্বিতীয় আয়াতটি নাযিল হওয়া প্রসংগে বলেছেন, ‘আয়াতটি আরবদের কিছুসংখ্যক লোকের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা কিছুসংখ্যক জিনের উপাসনা করত। অতঃপর জিনেরা ইসলাম গ্রহণ করল, অথচ তাদের উপাসনাকারী মানুষেরা তা টেরই পেল না।’ [মুসলিম ৩০৩০, বুখারী ৪৭১৪]
অসীলার প্রকারভেদ:
অসীলা দু’ প্রকার: শরীআতসম্মত অসীলা ও নিষিদ্ধ অসীলা।
১. শরীআতসম্মত অসীলা:
তা হল শরীআত অনুমোদিত বিশুদ্ধ ওসীলা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। আর তা জানার সঠিক পন্থা হল কুরআন ও সুন্নার দিকে প্রত্যাবর্তন এবং ওসীলা সম্পর্কে এতদুভয়ে যা কিছু এসেছে সেগুলো জেনে নেয়া। অতএব, যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নায় এ দলীল থাকবে যে, তা শরীআত অনুমোদিত, তাহলে তাই হবে শরীআতসম্মত অসীলা। আর এতদ্ব্যতীত অন্য সব অসীলা নিষিদ্ধ। শরীআতসম্মত অসীলা তিন প্রকার:
প্রথম: আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের কোনো একটি নাম অথবা তার মহান গুণাবলীর কোনো একটি গুণ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জন। যেমন মুসলিম ব্যক্তি তার দোআয় বলবে: হে আল্লাহ! আপনি যে পরম করুণাময় ও দয়ালু সে ওসীলা দিয়ে আমি আপনার কাছে আমাকে সুস্থতা দানের প্রার্থনা করছি অথবা বলবে: ‘আপনার করুণা যা সবকিছুতে ব্যপ্ত হয়েছে, তার ওসীলায় আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, যেন আমায় ক্ষমা করে দেন এবং দয়া করেন’ ইত্যাদি। এ প্রকার তাওয়াসসুল শরীআতসম্মত হওয়ার দলীল হল আল্লাহ তা’আলার বাণী “আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব, তোমরা তাঁকে সে সব নামেই ডাক।” [সূরা আল-আ’রাফ: ১৮০]
দ্বিতীয়: সে সকল সৎ কর্ম দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জন, যা বান্দা পালন করে থাকে। যেমন এরকম বলা যে, ‘হে আল্লাহ! আপনার প্রতি আমার ঈমান, আপনার জন্য আমার ভালোবাসা ও আপনার রাসূলের অনুসরণের ওসীলায় আমায় ক্ষমা করুন অথবা বলবে: ‘হে আল্লাহ! আপনার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য আমার ভালোবাসা এবং তাঁর প্রতি আমার ঈমানের ওসীলায় আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যেন আমায় বিপদমুক্ত করেন।’ এর দলীল আল্লাহ তা’আলার বাণী: “যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি; সুতরাং আপনি আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা করুন।” [সূরা আলে ইমরান: ১৬] আর এ বিষয়ের দলীলের মধ্যে রয়েছে তিন গুহাবাসীর কাহিনীও, যা সহীহ বুখারীতে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। [বুখারী ৩৪৬৫]
তৃতীয়: এমন সৎ ব্যক্তির দোআর ওসীলায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, যার দোআ কবুলের আশা করা যায়। যেমন এমন ব্যক্তির কাছে কোনো মুসলিমের যাওয়া, যার মধ্যে সততা, তাকওয়া ও আল্লাহর আনুগত্যের হেফাযত লক্ষ্য করা যায় এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে দো’আর আবেদন করা যাতে বিপদ থেকে মুক্তি ঘটে ও তার বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। শরীআতে এ প্রকার অনুমোদিত হওয়ার দলীল হল, সাহাবাগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ব্যাপক ও নির্দিষ্ট সকল প্রকার দো'আ করার আবেদন জানাতেন। হাদীসে রয়েছে, ‘এক ব্যক্তি জুমার দিন মিম্বরমুখী দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দাড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! গবাদি পশু ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে দো’আ করুন, যেন তিনি আমাদের জন্য বৃষ্টি অবতরণ করেন।’ আনাস বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তদ্বয় উঠিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ! আমাদের পানি দিন, হে আল্লাহ! আমাদের পানি দিন।” আনাস বলেন, আল্লাহর কসম, আমরা আকাশে কোনো মেঘ, ছড়ানো ছিটানো মেঘের খণ্ড বা কোনো কিছুই দেখিনি। আমাদের মধ্যে ও সেলা পাহাড়ের মধ্যে কোনো ঘর-বাড়ী ছিলো না। তিনি বললেন, এরপর সেলা পাহাড়ের পেছন থেকে ঢালের মত একখণ্ড মেঘের উদয় হল। মেঘটি আকাশের মাঝ বরাবর এসে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর বৃষ্টি হল। [বুখারী ১০১৩, মুসলিম ৮৯৭] তবে এ প্রকার অসীলা গ্রহণ শুধু ঐ ব্যক্তির জীবদ্দশায়ই হতে পারে, যার কাছে দোআ চাওয়া হয়। তবে তার মৃত্যুর পর এটা জায়েয নেই; কেননা মৃত্যুর পর তার কোনো আমল নেই।
২.নিষিদ্ধ অসীলা: তা হল- যে বিষয়টি শরীআতে ওসীলা হিসাবে সাব্যস্ত হয়নি, তা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জন। এটি কয়েক প্রকার, যার কোনো কোনোটি অন্যটি থেকে অধিক বিপজ্জনক। তন্মধ্যে রয়েছে-
মৃত ও অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকে আহবান করার মাধ্যমে, তাদের দ্বারা পরিত্রাণের আবেদন এবং তাদের কাছে অভাব মোচন, বিপদ থেকে মুক্তিদান প্রভৃতি প্রার্থনা করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জন। এটা শির্কে আকবার বা বড় শির্ক যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়।
কবর ও মাযারের পাশে ইবাদাত পালন ও আল্লাহকে ডাকা, কবরের উপর সৌধ তৈরী করা এবং কবরে প্রদীপ ও গেলাফ দেয়া প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। এটা ছোট শির্কের অন্তর্ভুক্ত, যা তাওহীদ পরিপূর্ণ হওয়ার অন্তরায় এবং বড় শির্কের দিকে পৌঁছিয়ে দেয়ার মাধ্যম।
নবীগণ ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিবর্গের সম্মান এবং আল্লাহর কাছে তাদের মান ও মর্যাদার ওসীলায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। এটা হারাম। বরং তা নবআবিস্কৃত বেদ’আতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তা এমনই তাওয়াস্সুল যা আল্লাহ বৈধ করেননি এবং এর অনুমতিও দেননি। এ ধরনের ওসীলা অবলম্বন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণের যুগে পরিচিত ছিল না। ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘দো’আকারীর এ কথা বলা মাকরুহ যে, ‘আমি আপনার কাছে অমুক ব্যক্তির যে হক্ব রয়েছে কিংবা আপনার অলীগণ ও রাসূলগণের যে হক্ব রয়েছে কিংবা বায়তুল্লাহ আল-হারাম (কাবা শরীফ) ও মাশ’আরুল হারামের যে হক্ব রয়েছে তার ওসীলায় প্রার্থনা করছি।’ [আত-তাওয়াসসুল ওয়াল অসীলা থেকে সংক্ষেপিত]
নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে, কিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে মুক্তির জন্য পণস্বরূপ যমীনে যা কিছু আছে যদি সেগুলোর সবটাই তাদের থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণও থাকে, তবুও তাদের কাছ থেকে সেসব গৃহীত হবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি [১]।
[১] জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এ আয়াত কাফেরদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। [ইবনু হিব্বান, (আল-ইহসান) ১৬/৫২৭, ৭৪৮৩]
Contents of the translations can be downloaded and re-published, with the following terms and conditions:
1. No modification, addition, or deletion of the content.
2. Clearly referring to the publisher and the source (QuranEnc.com).
3. Mentioning the version number when re-publishing the translation.
4. Keeping the transcript information inside the document.
5. Notifying the source (QuranEnc.com) of any note on the translation.
6. Updating the translation according to the latest version issued from the source (QuranEnc.com).
7. Inappropriate advertisements must not be included when displaying translations of the meanings of the Noble Quran.
نتائج البحث:
API specs
Endpoints:
Sura translation
GET / https://quranenc.com/api/v1/translation/sura/{translation_key}/{sura_number} description: get the specified translation (by its translation_key) for the speicified sura (by its number)
Parameters: translation_key: (the key of the currently selected translation) sura_number: [1-114] (Sura number in the mosshaf which should be between 1 and 114)
Returns:
json object containing array of objects, each object contains the "sura", "aya", "translation" and "footnotes".
GET / https://quranenc.com/api/v1/translation/aya/{translation_key}/{sura_number}/{aya_number} description: get the specified translation (by its translation_key) for the speicified aya (by its number sura_number and aya_number)
Parameters: translation_key: (the key of the currently selected translation) sura_number: [1-114] (Sura number in the mosshaf which should be between 1 and 114) aya_number: [1-...] (Aya number in the sura)
Returns:
json object containing the "sura", "aya", "translation" and "footnotes".